বেস্ত উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব বা কাতারের একটি রাজকীয় জনপ্রিয় পোশাকের বা কাপড়ের নাম। আর এই পোশাকগুলো সৌদি অথবা মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর রাজা-বাদশাহদের ঐতিহ্যবাহী। তবে গর্বের বিষয় হলো ধনী দেশের এই পোশাক এখন তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়।
বগুড়া জেলায় এই পোশাক তৈরি করে নিজের সংসারের পাশাপাশি অন্যদের সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। এইসব কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়।
জানা যায়, বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়ার হাপুনিয়া এলাকার নূর আলম প্রায় ২০ বছর আগে শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান। সেখানে বিশেষ ধরনের এই পোশাক তৈরি কারখানায় কাজ করেন তিনি। পাতলা কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে নকশা করা তার কাজ ছিল। এক পর্যায়ে ‘বেস্ত’ তৈরিতে হাতের কাজের সবগুলোতে দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি।
সৌদি আরবে থাকার কয়েক বছর পর নূর আলম কাতারে যান। সেখানেও তিনি এই বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার মালিকের সঙ্গে কথা বলে একটি কারখানা বাংলাদেশে স্থাপন করতে চান।
দেশে কমমূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চান। তখন তার কাতারের তৎকালীন মালিক রাজি হলে দেশে এসে নূর আলমসহ ১০ জন শ্রমিক মিলে বেস্ত তৈরির কাজ শুরু করেন। বগুড়া সদরের এরুলিয়া হাপুনিয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে ‘বেস্ত আল নূর’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন নূর আলম।
এ কারখানায় বিদেশি কাপড়ের হাতের কাজের নকশায় ‘বেস্ত’ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ‘বেস্ত আল নূর’ নামে কারখানায় এলাকার নারী-পুরুষ মিলে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। নূর আলম প্রায় সময়ই এখন কাতার কিংবা সৌদি আরবে থাকেন। কারণ কাতারে তার বেস্ত বিক্রির শোরুম রয়েছে। আর সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে তিনি দেশে তৈরি বেস্ত পাইকারি মূল্যে জোগান দেন। দেশে তার ব্যবসা দেখাশোনা করেন মানিক হোসেন।
কারখানার ম্যানেজার মানিক জানান, ‘ঈদের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসবে এ পোশাকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সৌদি কিংবা কাতার থেকে এই পোশাক তৈরির সব কাঁচামাল আমদানি করা হয়। সুতা, সুই থেকে শুরু করে কাপড় সবই আসে এক নম্বর মানের।
বেস্ত তৈরিতে স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রলেপযুক্ত সুতা, জরি ও নরম পাতলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। এ পণ্যগুলো সৌদি আরব, কাতার ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এমনকি এশিয়ার দেশ জাপান থেকেও আনা হয় এসব পণ্য।’ তিনি আরও জানান, ঐতিহ্যবাহী এই পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাত দিন লাগে। প্রথমে কাপড় কেটে নিয়ে সেখানে নকশার কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তুক্ত স্রিপ। বরুজ, মাকসার, বরদাক এরপর সিলালার মাধ্যমে শেষ হয় এর ধাপগুলো।
ধাপগুলো শেষ হলেই পূর্ণতা পায় ‘বেস্ত’। এই পোশাকের বাংলাদেশে কোনো চাহিদা নেই। সব পোশাকই যায় সৌদি আরবে কিংবা কাতারে। দামও খুব ভালো। সেখানে প্রতিটি ‘বেস্ত’ নকশাভেদে ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এই কারখানা থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়। এই হিসাবে এ কারখানা থেকে প্রতি বছর গড়ে ২৪ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করা হয়।
কাতারে এবার ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। এই সময় ‘বেস্ত’ পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
কারখানায় কর্মরত সাকিব হাসান জানান, সৌদি, কাতারের ঐতিহ্যবাহী ‘বেস্ত’ নামক পোশাক তৈরি করেই তার সচ্ছলতা এসেছে। পুঁজি হলে তিনি নিজেই এমন পোশাক কারখানা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
কারখানার শ্রমিক রিমা খাতুন জানান, তার বাবা কৃষিকাজ করেন। মা গৃহিণী। ভাইবোনের মধ্যে রিমা বড়। করোনায় কলেজ বন্ধ থাকার কারণে এখানে এসে হাতের কাজ শেখেন তিনি।
এখন প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় করেন। বগুড়া সদরের শিকারপুর পূর্বপাড়ার রুমা বেগম জানান, তার স্বামী ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক নূর আলম স্বামীকে এখানে কাজের সুযোগ করে দেন।
এখান থেকে আয়ের টাকা দিয়ে নিজের সংসার পরিচালনা করছেন। পলি বেগম জানান, নূর আলমের পোশাক কারখানায় কাজ করে এক ছেলেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন। তার বাড়ির কাছেই কারখানা। কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলেকে মানুষ করার জন্য ব্যয় করছেন।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক জানান, সদরের এরুলিয়া হাপুনিয়া এলাকায় নিজ বাড়িতে ‘বেস্ত আল নূর’ নামক কারখানাটি গড়ে উঠেছে। এটি বগুড়াবাসীর জন্য সুসংবাদ। তারা দেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সব সহযোগিতা করা হবে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন